...‘আমারে খুব কষ্ট দেয়।’
‘তাহলে ওকে আসতে দেও কেন?’
মানুষটা কোনো উত্তর দিল না। মতিন
আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন
আসতে দাও?’
‘না দিয়ে উপায় নাই।
লোভে পড়ে বিক্রি করে দিছি।’
‘কী বিক্রি করেছ?’
‘শরীরটা। এই শরীরটা। এখন দরকার
হলে ও ব্যবহার করে।’
‘কী করে ব্যবহার করে?’
‘জানি না। একেক সময় একেকটা করে।
খায়, অত্যাচার করে। আমি তো জানিনা।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘খালি গায়ে শুয়ে আছ কেন?’
‘গরম। অনেক গরম।’
পৌষ মাসের কনকনে শীত, আমরা চাদর
মুড়ি দিয়ে আছি, তার মধ্যে এই মানুষটার
গরম লাগছে। ঘামে শরীর
ভিজে জবজবে হয়ে আছে।
আমি আর মতিন একজন আরেকজনের
দিকে তাকালাম, ঠিক কী করব
বুঝতে পারছিলাম না। মতিন বলল, ‘আয়,
আমরা যাই।’
মানুষটা বলল, ‘দাঁড়াও।’
‘কী হয়েছে।’
‘তোমরা একটা কাজ করো।’
‘কী কাজ?’
‘আমাকে বেঁধে রেখে যাও।’
‘বেঁধে রেখে যাব?’
‘হ্যাঁ।’ মানুষটা বড় বড় নিঃশ্বাস
ফেলতে ফেলতে বলল, ‘আমাকে শক্ত
করে বেঁধে রেখে যাও।আল্লাহর কসম
লাগে!‘কেন?’
‘তা না হলে তোমাদের বিপদ হবে−অনেক
বিপদ। সময় নাই−তাড়াতাড়ি। ও আসছে।’
এই মানুষটার কথা ঠিক বিশ্বাস করব
কি না বুঝতে পারছিলাম না; কিন্তু
কোনো কারণ নেই, কিছু নেই,
একটা মানুষকে বেঁধে রাখে কেমন করে?
আমরা কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম
না, তখন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার
ঘটল। হঠাৎ করে চারদিক কেমন যেন
নীরব হয়ে গেল
−প্রথমে আমরা বুঝতে পারলাম না কেন,
একটু পর টের পেলাম ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোও
থেমে গেছে, গাছের পাতার শরশর শব্দও
শোনা যাচ্ছে না। এতক্ষণ
মানুষটা ছটফটকরছিল, হঠাৎ করে সে-ও
একেবারে থেমে গেছে, শক্ত
হয়ে শুয়ে আছে।
আমি আর মতিন নিঃশ্বাস বন্ধ
করে দাঁড়িয়ে আছি−হঠাৎ
মনে হলো বাইরে দিয়ে কে যেন এক
মাথা থেকেঅন্য মাথায় দৌড়ে গেল। গাছের
ওপর কিছু পাখি ছিল, পাখিগুলো ...
কিচিরমিচির করে উড়ে গেল। একটু
পরে আমরা আবার পায়ের শব্দ
শুনতে পেলাম, মনে হলো দুদ্দাড় করে কেউ
ছুটে আসছে। আমরা যে ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম
হঠাৎ সেই ঘরের দরজা দড়াম
করে খুলে গেল, মনে হলো ঘরের ভেতর
আগুনের হলকার মতোন একটা গরম
বাতাস ঢুকেছে।
তখন আমার জীবনের সবচেয়ে অবাক
ব্যাপারটা ঘটতে দেখলাম, চিৎ
হয়েশুয়ে থাকা মানুষটার পুরো শরীর হঠাৎ
করে ছিটকে ওপরে উঠে গেল।
মনে হলো তার সারা শরীরের ভেতরে যেন
কিছু কিলবিল করছে।
মানুষটারশরীরটা কয়েক সেকেন্ড
ওপরে ঝুলেথেকে হঠাৎ আছাড়
খেয়ে নিচে এসে পড়ল।
মানুষটা গোঙাতে থাকে।
আমরা বিস্কারিত চোখে দেখলাম
তারচেহারাটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।
চোয়ালের হাড়গুলো উঁচু হয়ে উঠল,
মনে হলো চোখ দুটো কোটর থেকে বের
হয়ে আসবে। জিব লম্বা হয়ে মুখ
থেকে বের হয়ে আসে, মাঢ়ি উঁচু
হয়ে দাঁতগুলো মুখের বাইরেচলে আসে।
মানুষটার সারা শরীর কেমন যেন
দোমড়াতে-মোচড়া তে থাকে।
আমি ও মতিন ভয়ে আর
আতঙ্কে একেবারে পাথরের
মতো জমে গেছি, নড়তে পারছি না। আমার
হাতের হারিকেনটা বারকয়েক দপদপ
করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। ঠিক
নিভে যাওয়ার আগে আমার
মনে হলো মানুষটা কুকুরের
মতো উঠে বসেছে, তারপর আমাদের
দিকে লাফ দিয়েছে।
আমি চিৎকার করে ঘরের দরজা খুলে বের
হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। পাগলের
মতো ছুটছি আর ছুটছি। মনে হচ্ছে আমার
পেছনে পেছনে লক্ষ লক্ষ জানোয়ার
ছুটে আসছে, এই বুঝি আমাকে ধরে ফেলবে!
ছুটতে ছুটতে আমি নিশ্চয়ই
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, তার পরে আমার
আর কিছু মনে নাই।
গহর মামা এই রকম সময়ে তাঁর কথা শেষ
করে কান চুলকাতে লাগলেন।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসেছিলাম।
এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার
পরে কী হলো মামা?‘মানুষটা ভালোই
আছে। মোটাতাজা হয়েছে।’ কী হলো?’
‘সকাল বেলা লোকজন আমাকে ...
...পেয়েছে।জ্ঞান নাই, মুখ
দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে।’
‘গ্যাজলা কী মামা?’
‘গ্যাজলা চিনিস না? লালার মতোন।
অনেক ভয় পেলে মুখ দিয়ে বের হয়।’
‘তারপর কী হলো? তোমার গল্প শেষ
করো মামা।’
‘গল্প তো শেষ। অনেক দিন
জ্বরে ভুগে আমি সুস্থ হয়েছি।
তবে একটা লাভ হয়েছে।’
‘কী লাভ হয়েছে মামা?’
‘আমার আর মাদ্রাসায় যেতে হয় নাই।’
‘আর মতিন? মতিনের কী হলো?’
গহর মামা কোনো কথা না বলে খুব
মনোযোগ দিয়ে কানে একটা আঙুল
ঢুকিয়ে চুলকাতে লাগলেন। আমরা আবার
জিজ্ঞেস করলাম, ‘মতিনের
কী হলো মামা?’
‘যা-যা, ঘুমাতে যা।’
‘কিন্তু মতিনের কী হলো?’
‘যা হবার হয়েছে, তোরা শুনে কী করবি?’
‘কী আশ্চর্য!’ আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
‘একটা গল্প শুরু করেছ, সেটা শেষ
করবে না? সব গল্পের একটা শেষ থাকে,
তুমি জানো না?’
‘থাকলে থাকে। আমার গল্প যেটুকু বলেছি,
সেটুকুই।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে,
তাহলে আমি বাকিটা বলি?’
গহর মামা বললেন, ‘বল।’
‘পরদিন সকালে মতিনের
ডেডবডি পাওয়া গেছে। শরীরটা সাদা আর
ফ্যাকাসে। কোনো রক্ত নাই−’
গহর মামা চোখ বড় বড় করে আমার
দিকে তাকালেন। কিছু
একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
আমি বললাম, ‘আর সেই মানুষটা−’
‘মানুষটা কী?’
‘কেন? মোটাতাজা কেন হয়েছে?’
‘রক্ত খুব ভালো প্রোটিন মামা,
তুমি জানো না?’*...
।।সমাপ্ত।।
‘তাহলে ওকে আসতে দেও কেন?’
মানুষটা কোনো উত্তর দিল না। মতিন
আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন
আসতে দাও?’
‘না দিয়ে উপায় নাই।
লোভে পড়ে বিক্রি করে দিছি।’
‘কী বিক্রি করেছ?’
‘শরীরটা। এই শরীরটা। এখন দরকার
হলে ও ব্যবহার করে।’
‘কী করে ব্যবহার করে?’
‘জানি না। একেক সময় একেকটা করে।
খায়, অত্যাচার করে। আমি তো জানিনা।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘খালি গায়ে শুয়ে আছ কেন?’
‘গরম। অনেক গরম।’
পৌষ মাসের কনকনে শীত, আমরা চাদর
মুড়ি দিয়ে আছি, তার মধ্যে এই মানুষটার
গরম লাগছে। ঘামে শরীর
ভিজে জবজবে হয়ে আছে।
আমি আর মতিন একজন আরেকজনের
দিকে তাকালাম, ঠিক কী করব
বুঝতে পারছিলাম না। মতিন বলল, ‘আয়,
আমরা যাই।’
মানুষটা বলল, ‘দাঁড়াও।’
‘কী হয়েছে।’
‘তোমরা একটা কাজ করো।’
‘কী কাজ?’
‘আমাকে বেঁধে রেখে যাও।’
‘বেঁধে রেখে যাব?’
‘হ্যাঁ।’ মানুষটা বড় বড় নিঃশ্বাস
ফেলতে ফেলতে বলল, ‘আমাকে শক্ত
করে বেঁধে রেখে যাও।আল্লাহর কসম
লাগে!‘কেন?’
‘তা না হলে তোমাদের বিপদ হবে−অনেক
বিপদ। সময় নাই−তাড়াতাড়ি। ও আসছে।’
এই মানুষটার কথা ঠিক বিশ্বাস করব
কি না বুঝতে পারছিলাম না; কিন্তু
কোনো কারণ নেই, কিছু নেই,
একটা মানুষকে বেঁধে রাখে কেমন করে?
আমরা কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম
না, তখন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার
ঘটল। হঠাৎ করে চারদিক কেমন যেন
নীরব হয়ে গেল
−প্রথমে আমরা বুঝতে পারলাম না কেন,
একটু পর টের পেলাম ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোও
থেমে গেছে, গাছের পাতার শরশর শব্দও
শোনা যাচ্ছে না। এতক্ষণ
মানুষটা ছটফটকরছিল, হঠাৎ করে সে-ও
একেবারে থেমে গেছে, শক্ত
হয়ে শুয়ে আছে।
আমি আর মতিন নিঃশ্বাস বন্ধ
করে দাঁড়িয়ে আছি−হঠাৎ
মনে হলো বাইরে দিয়ে কে যেন এক
মাথা থেকেঅন্য মাথায় দৌড়ে গেল। গাছের
ওপর কিছু পাখি ছিল, পাখিগুলো ...
কিচিরমিচির করে উড়ে গেল। একটু
পরে আমরা আবার পায়ের শব্দ
শুনতে পেলাম, মনে হলো দুদ্দাড় করে কেউ
ছুটে আসছে। আমরা যে ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম
হঠাৎ সেই ঘরের দরজা দড়াম
করে খুলে গেল, মনে হলো ঘরের ভেতর
আগুনের হলকার মতোন একটা গরম
বাতাস ঢুকেছে।
তখন আমার জীবনের সবচেয়ে অবাক
ব্যাপারটা ঘটতে দেখলাম, চিৎ
হয়েশুয়ে থাকা মানুষটার পুরো শরীর হঠাৎ
করে ছিটকে ওপরে উঠে গেল।
মনে হলো তার সারা শরীরের ভেতরে যেন
কিছু কিলবিল করছে।
মানুষটারশরীরটা কয়েক সেকেন্ড
ওপরে ঝুলেথেকে হঠাৎ আছাড়
খেয়ে নিচে এসে পড়ল।
মানুষটা গোঙাতে থাকে।
আমরা বিস্কারিত চোখে দেখলাম
তারচেহারাটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।
চোয়ালের হাড়গুলো উঁচু হয়ে উঠল,
মনে হলো চোখ দুটো কোটর থেকে বের
হয়ে আসবে। জিব লম্বা হয়ে মুখ
থেকে বের হয়ে আসে, মাঢ়ি উঁচু
হয়ে দাঁতগুলো মুখের বাইরেচলে আসে।
মানুষটার সারা শরীর কেমন যেন
দোমড়াতে-মোচড়া তে থাকে।
আমি ও মতিন ভয়ে আর
আতঙ্কে একেবারে পাথরের
মতো জমে গেছি, নড়তে পারছি না। আমার
হাতের হারিকেনটা বারকয়েক দপদপ
করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। ঠিক
নিভে যাওয়ার আগে আমার
মনে হলো মানুষটা কুকুরের
মতো উঠে বসেছে, তারপর আমাদের
দিকে লাফ দিয়েছে।
আমি চিৎকার করে ঘরের দরজা খুলে বের
হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। পাগলের
মতো ছুটছি আর ছুটছি। মনে হচ্ছে আমার
পেছনে পেছনে লক্ষ লক্ষ জানোয়ার
ছুটে আসছে, এই বুঝি আমাকে ধরে ফেলবে!
ছুটতে ছুটতে আমি নিশ্চয়ই
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, তার পরে আমার
আর কিছু মনে নাই।
গহর মামা এই রকম সময়ে তাঁর কথা শেষ
করে কান চুলকাতে লাগলেন।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসেছিলাম।
এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার
পরে কী হলো মামা?‘মানুষটা ভালোই
আছে। মোটাতাজা হয়েছে।’ কী হলো?’
‘সকাল বেলা লোকজন আমাকে ...
...পেয়েছে।জ্ঞান নাই, মুখ
দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে।’
‘গ্যাজলা কী মামা?’
‘গ্যাজলা চিনিস না? লালার মতোন।
অনেক ভয় পেলে মুখ দিয়ে বের হয়।’
‘তারপর কী হলো? তোমার গল্প শেষ
করো মামা।’
‘গল্প তো শেষ। অনেক দিন
জ্বরে ভুগে আমি সুস্থ হয়েছি।
তবে একটা লাভ হয়েছে।’
‘কী লাভ হয়েছে মামা?’
‘আমার আর মাদ্রাসায় যেতে হয় নাই।’
‘আর মতিন? মতিনের কী হলো?’
গহর মামা কোনো কথা না বলে খুব
মনোযোগ দিয়ে কানে একটা আঙুল
ঢুকিয়ে চুলকাতে লাগলেন। আমরা আবার
জিজ্ঞেস করলাম, ‘মতিনের
কী হলো মামা?’
‘যা-যা, ঘুমাতে যা।’
‘কিন্তু মতিনের কী হলো?’
‘যা হবার হয়েছে, তোরা শুনে কী করবি?’
‘কী আশ্চর্য!’ আমি অধৈর্য হয়ে বললাম,
‘একটা গল্প শুরু করেছ, সেটা শেষ
করবে না? সব গল্পের একটা শেষ থাকে,
তুমি জানো না?’
‘থাকলে থাকে। আমার গল্প যেটুকু বলেছি,
সেটুকুই।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে,
তাহলে আমি বাকিটা বলি?’
গহর মামা বললেন, ‘বল।’
‘পরদিন সকালে মতিনের
ডেডবডি পাওয়া গেছে। শরীরটা সাদা আর
ফ্যাকাসে। কোনো রক্ত নাই−’
গহর মামা চোখ বড় বড় করে আমার
দিকে তাকালেন। কিছু
একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
আমি বললাম, ‘আর সেই মানুষটা−’
‘মানুষটা কী?’
‘কেন? মোটাতাজা কেন হয়েছে?’
‘রক্ত খুব ভালো প্রোটিন মামা,
তুমি জানো না?’*...
।।সমাপ্ত।।